ভারতবর্ষ ভাগের ৭৫ বছর: সোহরাওয়ার্দীর অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন এবং ১৯৪৭-পূর্ববর্তী ভূমিকা

ভারতবর্ষ ভাগের ৭৫ বছর: সোহরাওয়ার্দীর অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন এবং ১৯৪৭-পূর্ববর্তী ভূমিকা

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তার পেছনে শুধু জওহরলাল নেহেরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো রাজনীতিবিদের নাম সবসময় আলোচনায় থাকলেও যে নামটি খুব একটা আলোচনায় থাকে না তিনি হচ্ছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৪৭-পূর্ব যেসব ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকায় ছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দী। এমনকি তার স্বপ্ন সফল হলে ভারত উপমহাদেশের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্নও হতে পারতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক হারুন-অর-রশিদ 'সোহরাওয়ার্দী বনাম বঙ্গবন্ধু' বইতে লিখেছেন, মি. সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বাংলায় মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান সংগঠক।

ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ও সোহরাওয়ার্দি

১৯৪৬ সালের ২৪ শে মার্চ ব্রিটিশ সরকার তাদের তিনজন মন্ত্রীকে ভারতবর্ষে পাঠায়। এটি ইতিহাসে ক্যাবিনেট মিশন হিসেবে পরিচিত।

এই ক্যাবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল কীভাবে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। এজন্য ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সাথে আলোচনা শুরু করে।

শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইতে লেখা হয়েছে, এমনভাবে ক্যাবিনেট মিশন আলোচনা করছিল, আমাদের মনে হচ্ছিল ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে।

কিন্তু এর বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' ঘোষণা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারকে দেখানো যে মুসলিমরা তাদের দাবির ব্যাপারে অনড় ও একাত্ম।

কিন্তু কংগ্রেস এবং হিন্দুরা বললেন, এই কর্মসূচীকে তাদের বিরুদ্ধে। সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।

১৬ই আগস্ট তিনি সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। কংগ্রেস এবং হিন্দুরা বললো তাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য সোহরাওয়ার্দী এ কাজ করেছেন।

কলকাতা শহরে ১৯৪৬এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলে ৫ দিন ধরে। মারা যায় অন্তত ২০০০ মানুষ, আহতের সংখ্যা ছিল চার হাজারের বেশি।

১৬ই আগস্ট কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক শুরু হলো। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য কংগ্রেস এবং হিন্দুরা সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করে।

কিন্তু মুসলিম লীগের ভাষ্য ছিল ভিন্ন। শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য বলেছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দী।

"তিনি বলে দিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোন গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে," লিখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

মি. সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে যেটা বলা হয় যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর একটা দায়িত্ব ছিল এই দাঙ্গাটা থামানোর। সেই দায়িত্বটা তিনি পুরোপুরি পালন করতে পারেননি।

তবে ঘটনা যাই হোক না কেন, মুসলিম লীগের অনেক নেতা মনে করতেন 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' না হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি বাস্তবায়ন হতো না।

স্বাধীন অখণ্ড বাংলার ধারণা

১৯৪৭ সালের ২৭ শে এপ্রিল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। দিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আচমকা একটি প্রস্তাব তুলে ধরলেন।

ব্রিটিশরা তখন ভারতবর্ষ বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হিসাবে ভারতে এসে উপমহাদেশ ভাগ করার পরিকল্পনা পেশ করেন।

মি. সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবটি ছিল, অবিভক্ত এবং স্বাধীন বাংলার ধারনা। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হতে যাচ্ছে তখন তিনি অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্রের ধারণা তুলে ধরেন।

সোহরাওয়ার্দির সেই প্রস্তাব যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে তিনটি রাষ্ট্রের জন্ম হতো।

বাংলা, আসাম এবং বিহার অঞ্চলের কয়েকটি জেলা নিয়ে বৃহৎ বাংলা নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর।

নেহেরু যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজী হলেন

ভারত-ভাগের নাটকীয় ঘটনাবলী, শেখ মুজিবের বয়ানে

সোহরাওয়ার্দীর নানা চেষ্টা

মুসলিম লীগের অন্য নেতাদের চেয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির চিন্তা ভাবনা ছিল ভিন্ন ধরণের।

সোহরাওয়ার্দী প্রথমে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার কথা বলেছিলেন।

কারণ তিনি ভাবছিলেন, একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা হলে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমদের আধিপত্য থাকবে। কিন্তু হিন্দু মহাসভা এর তীব্র বিরোধিতা করে।

ফলে সোহরাওয়ার্দির সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা গঠন করা।

তার এই অখণ্ড স্বাধীন বাংলার ধারণাকে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা প্রথম দিকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

কিন্তু কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব এই চিন্তাকে কখনোই আমলে নেননি।

আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ আয়েশা জালালের 'দ্য সোল স্পোকসম্যান: জিন্নাহ, দ্য মুসলিম লীগ এন্ড দ্য ডিমান্ড ফর পাকিস্তান' বইতে অনেক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

আয়েশা জালাল লিখেছেন, জিন্নাহর কৌশল অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার বিষটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জিন্নাহ বলেন, বাংলা যদি অবিভক্ত থেকে আলাদা রাষ্ট্র হয় তাতে তিনি আনন্দিত হবেন।

"লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে জিন্নাহ বলেছিলেন, কোলকাতা ছাড়া বাংলা কোন কাজে আসবে না। এর চেয়ে ভালো তারা অবিভক্ত এবং স্বাধীন থাকুক। আমি নিশ্চিত যে তাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকবে," লিখেছেন আয়েশা জালাল।

জিন্নাহর মনোভাব বুঝতে পরে সোহরাওয়ার্দি মনে করলেন বাংলাকে বিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করার এটাই মোক্ষম সুযোগ।

ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে মি. সোহরাওয়ার্দি বলেন ১৯৪৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতবর্ষ বিভক্ত করার বিষয়টি স্থগিত রাখতে।

সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবের মৃত্যু

সোহরাওয়ার্দীর ধারণা বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের অনেক নেতা এর বিপক্ষে ছিলেন।

তাদের কেউ কেউ মনে করতেন অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার চেয়ে পূর্ব বাংলায় মুসলিমদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র হলেই ভালো। তখন তারা বৃহত্তর পাকিস্তানের সাথে থাকবে।

১৯৪৭ সালের ২৩শে মে ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা নিয়ে নিয়ে বৈঠকে বসেন মাউন্টাব্যাটেন। সে বৈঠকে জওহরলাল নেহেরু বলেন, অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব তিনি মেনে নেবেন যদি তারা ভারত ইউনিয়নের মধ্যে থাকে।

আয়েশা জালালের বর্ণনা মতে, "নেহেরু সতর্ক করে দেন, বাঙালি হিন্দুরা সোহরাওয়ার্দির প্রস্তাবে বিভ্রান্ত হবে না। স্বাধীন বাংলা হরে সেখানে মুসলিম লীগের প্রাধান্য থাকবে এবং পুরো বাংলা পাকিস্তানের আওতায় চলে যাবে।"

৩১ শে মে মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করেন সোহরাওয়ার্দি। তিনি মাউন্টব্যাটেনকে জানান, অবিভক্ত বাংলা স্বাধীন করার বিষয়ে ভোটাভুটি করতে কংগ্রেস রাজি হবে না।

এছাড়া বাংলার মুসলিম লীগ নেতারাও সোহরাওয়ার্দির প্রস্তাব মেনে নিতে পারছেন না।

এমন অবস্থায় দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে একটি মাত্র উপায় খোলা আছে। সেজন্য কলকাতাকে 'ফ্রি সিটি' বা 'মুক্ত শহর' হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন সোহরাওয়ার্দি।

কলকাতাকে ছয়মাসের জন্য 'ফ্রি সিটি' ঘোষণা করার একটি প্রস্তাব লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঠিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেলের কাছে।

কিন্তু সর্দার প্যাটেল সাফ জানিয়ে দেন যে ছয় মাস তো দূরের কথা, ছয় ঘণ্টার জন্যও এটা সম্ভব নয়।

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য গণভোটের প্রস্তাবও করেছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দী এবং বাংলার মুসলিম লীগ।

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে।

কিন্তু কংগ্রেস নেতারা এ প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দেন।

অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার আশা যখন ক্ষীণ হয়ে আসে। কারণ কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ একমত না হলে স্বাধীন বাংলা নিয়ে নতুন কোন প্রস্তাব আলোচনা করতে চায়নি লর্ড মাউন্টব্যাটেন।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের জানিয়ে দেন যে দ্রুত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইন্ডিয়া বিল পাশ হবে এবং দুটো আলাদা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

সুতরাং বাংলা এবং পাঞ্জাব নিয়ে গণভোট আয়োজনের কোন সম্ভাবনা থাকবে না।

যদিও অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার পক্ষে লর্ড মাউন্টব্যাটেন নমনীয় ছিলেন এবং সেজন্য তিনি লন্ডনকে বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু নেহেরুর বিরোধিতার কারণে মাউন্টব্যাটেন সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন।

তখন ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য ছিল, তাদের দ্রুত ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হবে।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত দিন ধার্য করে ব্রিটিশরা। পাকিস্তান এর একদিন আগে অর্থাৎ ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা পায় এবং ক্ষমতা বুঝে নেয়।

ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও মি. সোহরাওয়ার্দি তাৎক্ষনিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন নি। তিনি কোলকাতায় অবস্থান করতে থাকেন।

অধ্যাপক ও গবেষক হারুন-অর -রশিদ লিখেছেন, মি. সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে যান এবং গান্ধীর সঙ্গে শান্তি মিশনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

১৯৪৮ সালে মি. সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানে আসলে তার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে খাজা নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার তাকে আবারো ভারতে পাঠিয়ে দেয়।

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে তিনি করাচীতে স্থায়ী হন।

অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ লিখেছেন, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সোহ্‌রাওয়ার্দীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

১৯৬৩ সালে লেবাননের বৈরুতে মারা যান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।