জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত রংধনু রফিকের চতুর্মুখী প্রতারণা
► একই জমি বন্ধক রেখে তিন ব্যাংক থেকে ঋণ, রফিকের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১৬২০ কোটি টাকা ► বন্ধকি জমি আবার ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করে হাতিয়েছেন ৪২৫ কোটি টাকা ► বন্ধকি জমি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেনাবেচা দেখিয়ে করেছেন জাল দলিল, পরে সেই জমি অন্যের কাছে বিক্রি
একে একে বেরিয়ে আসছে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলামের প্রতারণার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু জালিয়াতি করেই নিঃস্ব থেকে রাতারাতি অর্থবিত্তে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এই চেয়ারম্যান। প্রতারণার জালে ফেলেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে একাধিক ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে। সুকৌশলে জাল দলিল করে একই জমি বন্ধক রেখে একাধিক ব্যাংক থেকে তুলেছেন ঋণ। সেই বন্ধকি জমি আবার জালিয়াতি করে বিক্রি করেছেন ব্যক্তি পর্যায়ে। এসব অপকর্মে পরিবারের সদস্যদেরও কাজে লাগিয়েছেন। এভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে রফিকুল ইসলামের প্রতারণার ভয়ংকর তথ্য। তাতে দেখা গেছে, রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে কাউসার আহমেদ অপু নিজেদের জমি বিক্রি করেন। পরে বিক্রি করা জমি নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেনাবেচা করে জাল দলিল তৈরি করেন। জাল দলিলের জমি আবার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করেন। এওয়াজ বদলে পাওয়া সেসব জমি বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেন। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শুধু ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা থেকে হাতিয়েছেন ৯৪৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বন্ধকি জমি প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে আরও ৪২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রফিকুল ইসলাম ৪৭৫ কোটি টাকা নিয়েছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে, যা সুদসহ এখন দাঁড়িয়েছে ৭২৫ কোটি টাকায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২৭০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ২০০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের সুদসহ হিসাব করলে তার কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার বেশি। যদিও ঋণের কিস্তির টাকা না দেওয়ায় তিনি খেলাপি হতে চলেছেন। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনটি ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ হাতিয়ে নিলেও মর্টগেজ হিসেবে রাখা হয়েছে একই জমি। সেই জমির অধিকাংশই আবার তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছেন। বন্ধকি জমি ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে তুলে নিয়েছেন ৪২৫ কোটি টাকা। সেই জমি নিয়ে এখন রশি টানাটানি চলছে ব্যাংক ও জমির ক্রেতাদের মধ্যে। এদিকে রফিকুলের এমন চতুর্মুখী প্রতারণা আর জালিয়াতির খপ্পরে পড়ে ঋণ দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ জমিগুলো কিনলেও জমির বিপরীতে রফিকের নেওয়া ঋণ ও জাল দলিলের কারণে দখল নিয়ে আতঙ্কে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফিকুল ইসলামের এমন জালিয়াতিতে ব্যাংক ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন। অন্যথায় বিক্রি করা জমির বিপরীতে কীভাবে ঋণ নেন? আবার ঋণ নেওয়ার পর বন্ধকি জমি কীভাবে বিক্রি করেন? কারণ ব্যাংক বন্ধকি জমি সরেজমিন পরিদর্শন করে সব কাগজপত্র যাচাই করে জমির মূল্য নির্ধারণ করে। জমিটি বেচাকেনার ইতিহাস যাচাই করে। এ ছাড়া বন্ধকি জমির মূল দলিলও জমা রাখে।
যেভাবে রফিকের অভিনব প্রতারণা : প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রফিকুল ইসলাম পাঁচ দফায় রংধনু বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেড ও মেসার্স মেহেদী মার্টের নামে এসআইবিএল থেকে ৪৭৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল নেন ৬০ কোটি টাকা। একই বছরের ৩০ আগস্ট নেন ৮৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ১৮ মে নেন ২১৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই নেন ৩০ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নেন ৮৫ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধে অনিয়ম করায় বর্তমানে তার কাছে সুদাসলে ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২৫ কোটি টাকা। রফিকুল ইসলাম চলতি বছরের ২২ জুলাই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখা থেকে ২৭০ কোটি টাকা ঋণ নেন। রফিকুল ইসলাম, ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাউসার আহমেদ অপু ও ছেলের বউ মালিহা হোসেনের নামে এ ঋণ নেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল ইসলাম। কাউসার আহমেদ অপু ও রফিকুল ইসলামের নামে এ ঋণ নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রফিকুল ইসলাম জোয়ারসাহারা মৌজায় সিএস ও এসএ ৩২৫৯ নম্বর আরএস ৯৫৯৫ এবং সিটি জরিপ ৩৮০০৭ নম্বর দাগে ১৬.৫০ শতাংশ ভূমি ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ৩৯৮৪ নম্বর বন্ধকি দলিলে এসআইবিএলের বসুন্ধরা শাখায় বন্ধক রাখেন। বন্ধকি সেই জমি আবার ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ১১৯৩৪ নম্বর সাফ কবালা দলিলমূলে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের কাছে বিক্রি করে দেন।
আবার এসআইবিএল থেকে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট নেওয়া ৮৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে রফিকুল ইসলাম জোয়ারসাহারা মৌজার সিএস ও এসএ ৩২৮৫, ৩৩৫৯, ৩৩৭০ নম্বর, আরএস ১০০১৭, ১০০১৫, ১০০১৪ নম্বর, সিটি জরিপ ৪৮৮১৭, ৪৮৫৯৪, ৪৮৫৯৫ নম্বর দাগের ৩৮.০৮ শতাংশ জমির দলিল বন্ধক রাখেন। ওই বন্ধকি জমিগুলোই আবার ২০২৩ সালের ২২ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে ৯৫৪৯ নম্বর দলিলমূলে বন্ধক দেন। এসব জালিয়াতিতে তিনি কাজে লাগিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। এর মধ্যে রফিকের ছেলে কাউসার আহমেদ অপুর মালিকানায় দেখানো ০.৩৬৩০ একর জমি এসআইবিলের ৮৬৭৯ নম্বর দলিলে বন্ধক ছিল। যার সিএস ও এসএ দাগ ১৯৪৬ ও ১৯২১, আরএস দাগ ৭৫১৪ ও ৭৫১৬, সিটি জরিপ দাগ ১৯১২১ ও ১৯১৩৩। ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট জমিটি এসআইবিএলে বন্ধক দেওয়া হয়। অথচ একটি প্রতিষ্ঠানকে জমির আমমোক্তার বানিয়ে ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর মো. জাকির হোসেনের কাছে জমিটি বিক্রি করে দেন তিনি। এ ছাড়া রফিকুলের ছেলে কাউসার আহমেদ অপু নারায়ণগঞ্জের নাওড়া মৌজার আরএস ১১৪৬, ৩২৭, ৫৬৩৫, ৪৭, ২৪৯ নম্বর দাগে ৬৬.৮০ শতাংশ জমি ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি তাসফিয়া আহসান জইতার কাছে বিক্রি করেন। জইতার কাছে বিক্রি করা জমিটি ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ৭৪৭৪ নম্বর সাফ কবালা দলিলমূলে তার পিতা রফিকুল ইসলামের কাছে পুনরায় বিক্রি করে জাল দলিল বানান। এরপর ওই জমিটি রফিকুল ইসলামের মালিকানা দেখিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল করে নতুন জমি নেন। জাল দলিলের পাওয়া এওয়াজ বদলের জমি বন্ধক রেখে এসআইবিএল ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন রফিকুল ইসলাম।
২০১৯ সালের ৮ মে ৪৭১৯ নম্বর বন্ধকি দলিলে এসআইবিএল থেকে নেওয়া ২১৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ভাটারা মৌজার ১৯১৩৩, ১৯০২০, ১৯১৩২ নম্বর দাগে ৩৯.৬০ শতাংশ জমি বন্ধ রাখেন রফিকুল। জমিটি বন্ধক দেওয়ার দুই বছর পর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে আমমোক্তার নিয়োগ দেন।
শুধু ছেলে নয়, প্রতারণার কাজে ছেলের বউদেরও ব্যবহার করেছেন রফিকুল ইসলাম। রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার ১১৭৬১ নম্বর দলিলের ০.৬১ একর জমির মালিকানায় ছিলেন রফিকুল ইসলাম। ০.৬১ একর জমির মধ্যে ২০১৬ সালের ৩ মার্চ মো. আকবর হোসেনের কাছে ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ০.১৫ একর বিক্রি করেন রফিক। বাকি .৪৬ একর জমির মধ্যে ০.১৫ একর জমি ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তামরিন মুজিবের কাছে বিক্রি করেন। দলিলে দেখা যায়, তামরিন মুজিবও ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ওই জমি কেনেন। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি ০.১৫ একর জমি কেনেন সাহানা আক্তার খানম। তিনটি পৃথক দলিলে ০.৪৫ একর জমির পর রফিকের মালিকানায় ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ জমি। কিন্তু রফিক ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার ছেলের বউ মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে পুনরায় ৬১ শতাংশ জমির পুরোটা বিক্রি দেখিয়ে জাল দলিল করেন। ওই জমিটি ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এওয়াজ বদল দলিলে জোয়ারসাহারা মৌজার ০.৬৩৪ একর জমি পান। মালিহা হোসেন ও হুমায়রা নুজহাতের কাছে জমি বিক্রির কিছুদিন পর ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মালিহা তার স্বামী মেহেদী হাসান দিপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ ও হুমায়রা নুজহাত স্বামী কাউসার আহমেদ অপুর নামে ৩১.৭ শতাংশ সম্পত্তি হেবা দলিল করেন। তার ছেলের বউয়েরা জাল দলিলের জমিটি তাদের স্বামীদের নামে অর্থাৎ রফিকুলের দুই ছেলেকে দেওয়ার পর দুই ছেলের নামে ৬৩.৪ শতাংশ জমি দেখিয়ে প্রথমে ২০১৯ সালের ৮ মে এসআইবিএলে বন্ধক রাখেন। পরে একই জমি ২০২৩ সালের ২২ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন।
এ ছাড়া ভাটার মৌজার ঢাকা সিটি জরিপ ৩০০৮ এ ০.১৫৫৩ একর জমি ছিল রফিকুল ইসলামের; যা ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তামান্না সুলতানার কাছে বিক্রি করে দেন। দলিল নম্বর ২৮০৮। ২০২৩ সালের ২২ জুন ওই জমিটিই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেন রফিকুল ইসলাম, তার ছেলে মেহেদী হাসান দিপু, কাউসার আহমেদ অপু ও পুত্রবধূ মালিহা হোসেন। রফিকুল ইসলামের থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ৫৫১, ৫৫২, ৫৫৬, ৫৫৭ ও ৫৫৮ প্লট কেনেন মালিক ইমরান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার আইনজীবী মলয় রায় বলেন, গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পেরেছি রফিকুল ইসলাম আমাদের জমি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়েছেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, জমির মালিক রফিক নন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।