বিএনপির বিকল্পই কি বিএনএম!
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিকল্প হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে একটি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধনের পর দলটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে। বিএনপি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে, এই বিএনএমের ব্যানারে বিএনপির অন্তত অর্ধশত নেতা নির্বাচন করতে পারেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যম ও তার ওপরের সারির এসব নেতা ইতোমধ্যেই বিএনএমের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ রাখছেন। বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়, পদবঞ্চিত ও সাবেক অনেক এমপিও রয়েছেন এই তালিকায়। তবে বিএনএমের দাবি, বিএনপি ভাঙাগড়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। আওয়ামী লীগ থেকেও অনেকে তাদের সদস্য হচ্ছেন। এটি একটি আলাদা রাজনৈতিক উদ্যোগ। ভালো মানুষকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এই দলের উদ্দেশ্য।
বিএনএম গঠনের উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রহমান বলেন, বিএনএমের লক্ষ্য ক্ষমতা অর্জন নয়, এমপি-মন্ত্রী হওয়াও না, কোনো দলকে ভাঙাও নয়। আমাদের উদ্দেশ্য—এমন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে কিছু মানুষ একত্রিত হবে, যারা দেশকে ভালোবাসে এবং নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে রাজনীতিতে নিমজ্জিত করতে চায়। এ রকম মানুষের মিলনমেলা হবে এই দল। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই বিএনএমের লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
২৭ দফা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএনএম। দলটির আহ্বায়ক করা হয় ড. আব্দুর রহমানকে, যিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে বরগুনা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন। এ ছাড়া সপ্তম সংসদ নির্বাচনেও একই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে ‘জাগো ছাত্রদল’ দিয়ে আব্দুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পরে তিনি বরগুনা জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হন। এরপর জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একপর্যায়ে গ্রেটার বরিশাল ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ বরগুনা জেলা বিএনপির সহসভাপতি এবং বেতাগী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন।
আব্দুর রহমান বলেন, ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারপর স্বেচ্ছায় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পিএইচডি করতে ভারত যান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছেন।
বিএনএম গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা মেজর (অব.) ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন, যিনি পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য। সদস্য সচিব পদে আছেন মেজর (অব.) মো. হানিফ। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক এই সদস্য স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০২১ সালের ২৮ জুন পদত্যাগ করেন। ৭৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ১৮ জন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, ৫ জন ডক্টরেট এবং ২২ জন ব্যারিস্টার/আইনজীবী রয়েছেন। কমিটিতে বিএনপির ৫-৬ জন সাবেক নেতা আছেন। কমিটিতে উল্লেখযোগ্য অন্যরা হলেন—যুগ্ম আহ্বায়ক মেজর জেনারেল (অব.) এহতেশাম উল হক, অধ্যাপক ডা. ইকবাল হোসেন মাহমুদ, ড. মো. শাহজাহান, ড. মো. সামসুল আলম; সদস্য ড. আবু শামস মো. খালেকুজ্জামান, মেজর (অব.) মো. ইমরান, লে. কর্নেল (অব.) মো. আলমগীর হোসাইন, মেজর (অব.) একেএম সাঈদুর রহমান, মেজর (অব.) মিজানুর রহমান প্রমুখ। এ ছাড়া আরও ২০ জন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ইতোমধ্যে দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৯৩টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১২টিকে নিবন্ধনের জন্য ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে। সেই তালিকায় বিএনএমও রয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, নিবন্ধন পাওয়ার জন্য তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ করতে হবে। কিন্তু তারা দুটি শর্ত পূরণ করেছেন। তাদের দলের আহ্বায়ক একজন সাবেক এমপি। এ ছাড়া ২৩টি জেলা-মহানগর এবং ১০৪টি উপজেলায় তাদের সক্রিয় কার্যালয় ও কমিটি রয়েছে। গত ৯ মে মহাখালীতে বিএনএমের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শন করে নির্বাচন কমিশনের ৩ সদস্যের টিম। এ সময় তারা দলের কার্যক্রম, গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, বিভিন্ন রেজ্যুলেশন, অফিস ভাড়ার চুক্তিপত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করেন। পরিদর্শন শেষে নির্বাচন কর্মকর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন বলে দাবি বিএনএম নেতাদের।
জানা গেছে, নিবন্ধন পাওয়ার পর সারা দেশে জেলা পর্যায়ে ব্যাপক আকারে সংগঠন গড়ে তোলায় সচেষ্ট হবে বিএনএম। এ ক্ষেত্রে বিএনপিতে নিষ্ক্রিয় ও পদবঞ্চিতদের সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন নেপথ্যে থাকা নেতারা। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত হলে দলের ভিন্নমতের নেতা ও অনেক সাবেক সংসদ সদস্য বিএনএমে যোগ দিতে পারেন। নতুন এই দলের ব্যানারে তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, বিএনএম এখন দুটি কাজ করছে—সদস্য সংগ্রহ ও নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই। নেতাদের দাবি, ইতোমধ্যে ৫০ হাজারের অধিক লোক বিএনএমের সদস্যপদ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি জেলা বিএনপির একজন সাবেক সভাপতি ও দলটির একটি জেলার পুরো অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। আর ‘এমপি প্রার্থী’ বাছাইয়ে কাজ করছে বিএনএমের ১০ সদস্যের একটি কমিটি, আগামী নির্বাচনের জন্য যারা ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক প্রার্থী বাছাই করেছে।
সূত্রমতে, নিবন্ধন পাওয়ার পর বিএনএমসহ পাঁচটি দলের সমন্বয়ে ‘নির্বাচনী জোট’ গঠনের প্রক্রিয়াও গতিশীল হবে, যা এখন আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দুটি নিবন্ধিত দল এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় থাকা তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে দলটি থেকে নেতা ভাগিয়ে নতুন এই জোট ভোটে অংশ নেবে—এমনই ছক কষছেন নেপথ্য নেতারা। নতুন এই ‘নির্বাচনী জোট’ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দাবি, জোটের পাঁচটি দলই নিবন্ধিত হবে। ফলে নির্বাচনী মাঠে তখন এই জোটের অন্যরকম গুরুত্ব থাকবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনএমের এক নেতা বলেন, নির্বাচনী জোট হতে পারে। যারা ডাইনেস্টির (পরিবারতন্ত্র) বাইরে রাজনীতি করতে চায়, তাদের ৯০ ভাগের নীতি-আদর্শ এক। সেক্ষেত্রে তাদের এক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জোট হলে দুই প্রতিষ্ঠিত দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) বাইরে যার যেখানে বিজয়ী হওয়ার মতো লোক থাকবে, তাদের সেখানে প্রার্থী করা হবে। আর যদি জোট না হয়, তাহলে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বিএনএম।’ ওই নেতা আরও জানান, বিএনএমের স্ট্র্যাটেজি হলো ইমরান খানের মতো। ইমরান খান দুই নির্বাচনে একটি আসনও পাননি। কিন্তু মাঠে তার প্রার্থী দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছেন। সেটা ছিল একটা ক্যাম্পেইন। পরে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আমরাও সেটাই করতে চাই।
বিএনএম গঠনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি ভাঙার কিছু নাই। বিএনপি এই মুহূর্তে যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে—দক্ষ, যোগ্য, সৎ লোককে কোনোভাবেই মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে সেখানে আমাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। সেজন্য আমরা নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বিএনপির ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শাসন দেখেছে, তারা দলটির রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হবে না। অন্যদিকে এখন যারা আওয়ামী লীগের শাসন দেখছে, তারা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগে আকর্ষণ ফিল করবে না। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এখন রাজনীতিতে আসছে না, দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। যার জন্য একটা শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল (দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী) যেভাবে সফল হয়েছেন, সেই ক্ষেত্রটা আমরা প্রস্তুত করতে চাই। ওইটা হলো আমাদের আগ্রহের জায়গা।’