বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইতিহাস
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত ও সংসদীয় উভয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি মাঝেমধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল মোতাবেক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান প্রবর্তিত হয়। পরে সংবিধানের (১২তম সংশোধনী) আইন ১৯৯১ অনুসারে সংসদীয় পদ্ধতি চালু হলে পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা হয়। বর্তমানে অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুসারে সংসদ-সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে দেশে এ পর্যন্ত ১১টি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে পরোক্ষ ভোটে ৮টি নির্বাচন হয় এবং প্রত্যক্ষ/সরাসরি ভোটে হয় তিনটি নির্বাচন। বাকি রাষ্ট্রপতিদের কেউ কেউ স্পিকারের পদে থেকে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করেন। কেউ কেউ সাময়িক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নির্বাহী আদেশে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। তফসিল ঘোষিত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আনুষ্ঠিকতা শেষ হলে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২টিতে।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক তিন বার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আবদুল হামিদ দুই বার নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি স্পিকার হিসেবে পদাধিকার বলে একবার অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আবদুল হামিদ সব চেয়ে বেশিদিনও (টানা ১০ বছর) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হলেও স্বাধীনতার পরপরই মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। এর ফলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তার অবর্তমানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। তার দায়িত্বভার ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সে সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয় জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এর দুই দিন পর ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন হলে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। একই দিনে দেশের রাষ্ট্রপতি হন আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর তিনি টানা তিন মেয়াদে ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তার বিদায়ের দিনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পান স্পিকার মোহাম্মদ মুহম্মদউল্লাহ। ৩৫ দিন অস্থায়ী দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৭৪ সালে ২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথমবারের মতো ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৪ সালে। নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা তাকে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত করেন। মুহম্মদউল্লাহ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সংবিধান সংশোধন করে আবারও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তনের ফলে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতির পিতা দ্বিতীয়বারের মতো দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে নতুন যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, সেখানে রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অন্যতম খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে থাকতে পেরেছেন। ওই দিন নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম। তবে এ সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সব চাবিকাঠী ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। বিচারপতি সায়েম দেড় বছরের মতো অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর জিয়াউর রহমান নিজেই রাষ্ট্রপতি হন। জিয়াউর রহমান প্রথম দফায় ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১৯৭৮ সালের ১২ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর ওইদিনই দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। জিয়ার প্রথম মেয়াদের দায়িত্ব নির্বাহী আদেশে হলেও দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন শুরু হয় প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে। ১৯৭৮ সালের ১২ জুন তার দ্বিতীয় মেয়ার শুরুর কয়েকদিন আগে ৩ জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। নির্বাচনে জিয়াউর রহমান ৭৬.৬ শতাংশ এবং ওসমানী ২১.৭ শতাংশ ভোট পান। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে আততায়ীর হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার দিন পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেদিন (৩০ মে ৮১) দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ছয় মাসের মতো অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮১ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হন।এর আগে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তার ৬৫.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেন পান ২৬ শতাংশ ভোট। সাত্তার ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান। এ সময় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশে সামরিক শাসন জারি করলে দেশের ১২তম রাষ্টপ্রতি হিসেবে আবুল ফজল মুহম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসান। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এইচএম এরশাদ দেশের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরশাদ প্রথম মেয়াদে ২৩ অক্টোবর ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর সরকারি ভোটে বিজয়ী হয়ে ২৩ অক্টোবর ১৯৮৬ থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এর আগে ১৫ অক্টোবর দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্জন করে। দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ওইদিন (১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর) দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (১৪তম) হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে প্রধান বিচারপতি পদে প্রত্যাবর্তন করেন।
এর আগে সংবিধান সংশোধন (১২তম সংশোধন) করে রাষ্ট্রপতি সরকারের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরসরি জনগণের ভোটের পরিবর্তে আবারও সংসদ সদস্যদের (পরোক্ষ ভোটে) ভোটে অনুষ্ঠানের বিধান চালু হয়। এর পর থেকেই এ বিধান চলমান রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সরকার প্রবর্তনের পর অনুষ্ঠিত পরোক্ষ ভোটে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরদিন ৯ অক্টোবর তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ওই একবারই সংসদে ভোট হয়েছে। ওই সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী বিএনপির আব্দুর রহমান বিশ্বাসের কাছে পরাজিত হন।নির্বাচনে আব্দুর রহমান বিশ্বাস পান ১৭২ ভোট ও বদরুল হায়দার চৌধুরী পান ৯২ ভোট। এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। দেশের ১৬তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সাহাবুদ্দিন আহমদ এ দফায় ২০০১ সালে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে একিউম বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশের ১৮তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে দেড় বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পর ইমপিচমেন্ট পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে ২০০২ সালের ২১ জুন পদত্যাগ করেন। এ সময় সংবিধান অনুযায়ী, দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির (১৯তম) দায়িত্ব পান স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। এ সময় বিএনপির মনোনীত প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সালে দেশের ২০তম রাষ্ট্রপ্রতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দেশের ২০তম রাষ্টপ্রতি হিসেবে জিল্লুর রহমান ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে ২০১৩ সালের ২০ মার্চ তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন হিসেবে মৃত্যু বরণ করেন। অবশ্য মৃত্যুর ৬ দিন পূর্বে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে (১৩ মার্চ) স্পিকার আবদুল হামিদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২৪ এপ্রিল তিনি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে দ্বিতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দেয়। আবদুল হামিদের নতুন এ মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হবে।