বহিষ্কৃত পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভয়ঙ্কর অপহরণ সিন্ডিকেট!
মুক্তিপণ দেওয়ার পরও মেলে না মুক্তি, স্বামীর হাত-মুখ বেঁধে তারই সামনে লুণ্ঠিত হয় স্ত্রীর সম্ভ্রম! কক্সবাজারকেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর এক অপহরণ সিন্ডিকেটের অবস্থান শনাক্তের পর একের পর এক তাদের সুরক্ষিত গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে সেখানে বন্দি এক নারীসহ পাঁচ অপহৃত ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে র্যাব।
এ সময় গ্রেফতার করা হয় চক্রের মূল হোতা, পুলিশের বহিষ্কৃত উপপরিদর্শক (এসআই) এসএম ইকবাল পারভেজসহ চক্রের তিন সদস্যকে।
শুক্রবার কক্সবাজার র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীমের নেতৃত্বে র্যাবের একটি দল কক্সবাজার শহরের কলাতলী ও সুগন্ধা এলাকায় রাতভর এ অভিযান পরিচালনা করে।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ মে কক্সবাজার বেড়াতে এসে নিখোঁজ হন ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা মো. শাহজাহান কবির ও মঞ্জুর আলম । পরে একটি মোবাইল নম্বর থেকে কল করে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আংশিক মুক্তিপণ পরিশোধ করা হলেও মুক্তি মেলেনি শাহজাহান ও মঞ্জুরের।
কক্সবাজারের উখিয়া থানাধীন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা অপহৃত দম্পতির গল্প আরও ভয়ঙ্কর। দাবিকৃত মোটা অংকের টাকা না পেয়ে স্বামীর হাত-মুখ বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে থাকে চক্রের সদস্যরা। স্বামীর ওপর চলতে থাকে মধ্যযুগীয় অমানবিক বর্বর নির্যাতন।
অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনরা বিকাশে দুই লক্ষাধিক টাকা মুক্তিপণ দিলেও তাদের ছাড়া হয়নি। অপহরণকারীদের দাবি আরও অনেক বেশি। বেদম মারধরের পাশাপাশি চাহিদামতো মুক্তিপণ না দিলে অপহৃতদের মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।
নিরুপায় হয়ে স্বজনরা বিষয়টি র্যাবকে অবহিত করলে গোয়েন্দা উপাত্ত ব্যবহার করে কাজ শুরু করেন তারা।
এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার পৌর শহরের কলাতলী ও সুগন্ধা এলাকায় এই সিন্ডিকেটের দুটি সুরক্ষিত ও গোপন আস্তানার সন্ধান পায় র্যাব। পরে রাতভর এসব আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে প্রথমে কলাতলী হতে চক্রের দুই সদস্যকে এবং পরে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সুগন্ধা এলাকার অপর গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে চক্রের প্রধান পুলিশের বহিষ্কৃত উপপরিদর্শক (এসআই) এসএম ইকবাল পারভেজকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করে র্যাব হেফাজতে নিয়ে আসা হয় সেখানে জিম্মি হিসেবে আটক পাঁচ নারী-পুরুষ ভিকটিমকে। উদ্ধারের পর র্যাব ও স্থানীয় জনতার সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী অভিযোগ করেন যে, তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের পাশাপাশি স্বামীর হাত-মুখ বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণও করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চক্রের প্রধান ইকবাল পারভেজ ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পুলিশের এসআই হিসেবে কর্মরত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ র্যাবের নিকট ধরা পড়েন। এতে দীর্ঘদিন কারাভোগের পাশাপাশি চাকরিও হারান তিনি। চাকরি থেকে বরখাস্ত ও কারাগার থেকে বের হওয়ার পর এসআই (বরখাস্তকৃত) ইকবাল তার শ্যালক মুন্নাসহ অন্য ৭-৮ জন সহযোগী নিয়ে গড়ে তোলেন অপহরণ বাণিজ্যের রমরমা এ সিন্ডিকেট।
চক্রের সদস্যরা দেশের নানা প্রান্ত থেকে কক্সবাজার আসা মানুষদের টার্গেট করে অপহরণ করে তাদের স্বজনদের নিকট ফোন করে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করত। প্রত্যাশামাফিক টাকা না পেলে আটককৃতদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হতো। আটকাবস্থায় অপহৃত নারীদের যৌনদাসী হিসেবেও ব্যবহার করত।
র্যাবের অভিযানে গ্রেফতারকৃত অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা এসএম ইকবাল পারভেজ (৪০) চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন মাইতুল সরকারবাড়ি এলাকার মৃত এরশাদ আলমের ছেলে। ২০২১ সালে ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যা মামলা থাকার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত এমটি মুন্না (৩০) পিতা মো. ইউনুস এবং মো. ইউসুফ, পিতা মৃত আব্দুল করিম উভয়ের বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডস্থ নতুন বাহারছড়া এলাকায়। গতকাল ১৯ মে অপহরণের শিকার শাহজাহান কবিরের বোন মোসা. আমেনা বেগম বাদী হয়ে গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। আসামি ও উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়ার জন্য কক্সবাজার সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে মর্মে নিশ্চিত করে র্যাব সূত্র।
এ বিষয় জানতে চাইলে কক্সবাজার র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক অপহরণ- মুক্তিপণ সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে র্যাবের যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, তারই অংশ হিসেবে আমরা এ অভিযান পরিচালনা করেছি।
এ ছাড়া গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি, তদন্তের স্বার্থে যা এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ চক্রের অপরাপর সদস্যদেরও শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে। কক্সবাজারে অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য নির্মূল হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এমন সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।