গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য, ভোগান্তিতে নগরবাসী
রাজধানীর গণপরিবহনে যাত্রী ও কন্ডাক্টরের মধ্যে ভাড়া নিয়ে তর্ক বিতর্ক এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কোথাও আবার পুরোটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে অন্যান্য খাতের মতো গণপরিবহনে চলছে নৈরাজ্য। সরকার ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও মানছে না বাসমালিক কর্তৃপক্ষ। সারা দেশে অধিকাংশ গণপরিবহন নিজের ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে। এতে চরম হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়ছে যাত্রীরা। কখনো কখনো ভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন যাত্রীরা। রাজধানীতে ওয়েবিল ও চেকার বহাল রেখে একই গন্তব্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
গুলিস্তান থেকে গাজীপুর এবং সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুর রুটে যাত্রীদের দিতে হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া। এই রুটে কিছু বিষয় চোখে পড়ে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সিটিংয়ের নামে প্রতারণা, কম দূরত্বে যাত্রী না ওঠানো। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জনবহুল নগরীর গণপরিবহনগুলো। এসব পরিবহনের চালকদের কাছে অনেকটাই জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। গণপরিবহনের এমন ভয়াবহ নৈরাজ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।
রাজধানীর আয়তন ১১৬ দশমিক ৮ বর্গমাইল। এই ছোট্ট জায়গায় বসবাস করছে দুই কোটির চেয়ে কিছুটা বেশি মানুষ। রাজধানীতে যাতায়াতের জন্য রুট রয়েছে মাত্র ১২২টি। এ রুটগুলোয় চলাচল করছে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার গণপরিবহন। রাজধানীর রাজপথে গণপরিবহনের ভাড়া আদায়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাসে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে চালক-কন্ডাক্টরদের। কোনো কোনো বাসে হয় মারামারিও। কারণ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ টাকা বেশি দাবি। ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা করে যাত্রীদের মাঝপথে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে বহু। এ ছাড়া গণপরিবহনগুলো দিন দিন সিটিং সার্ভিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। সিটিং মানে সিটভর্তি যাত্রী। অতিরিক্ত বা দাঁড়িয়ে যাত্রী যাবে না। কিন্তু এ নিয়ম তারা মানছে না। সিটভর্তি যাত্রী থাকলেও দাঁড় করিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিচ্ছে তারা। আর কম দূরত্বের কোনো যাত্রী গাড়িতে ওঠান না চালকরা। লোকাল বা সিটিং বাস কোনোটাতে ঠাঁই পান না কম দূরত্বের যাত্রীরা। ১৫ টাকার দূরত্বে যাওয়া যাত্রীকেও না। গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে এমন নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী।
যাত্রীদের অভিযোগ, বাসগুলোর সুপারভাইজাররা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন। এমন কী একই বাস কোম্পানির স্টাফরা একই গন্তব্যের জন্য আলাদা ভাড়া আদায় করছেন। বাস মালিকদের নির্দেশেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান একাধিক বাসচালক।? এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে অন্তত ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে পণ্য পরিবহনের ভাড়া। রাজধানীতে বিভিন্ন রুটের বাসে ব্যবহৃত ওয়েবিল প্রথা বাতিল ঘোষণা করা হলেও তা মানছেন না পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। পাশাপাশি স্টপেজ বাদেও খোলা থাকছে বাসের দরজা, চলছে যাত্রী ওঠা-নামা। অনেক বাসে ভাড়ার নতুন চার্ট থাকলেও ইচ্ছেমতো বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, অভিযোগ যাত্রীদের। এসব বিষয়ে তদারকির দাবি তাদের।
এদিকে ওয়েবিল ব্যবস্থায়, বাসে উঠে পরের স্টপেজে নামলেও পরবর্তী ওয়েবিলের স্থান পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। সম্প্রতি পরিবহন মালিক সমিতি ওয়েবিল প্রথা বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি। গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় ও অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে বিআরটিএ ও পরিবহন মালিক সমিতির ৯টি ভিজিলেন্স টিম কাজ করার কথা থাকলে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি রাজধানীতে।
অভিযোগ স্বীকার করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব বাসমালিক ওয়েবিল-চেকার পদ্ধতি বাতিল করেছেন, তারা আগের থেকে কম টাকা জমা পাচ্ছেন। সে কারণে অনেকেই এখনো ওয়েবিল-চেকার পদ্ধতি বহাল রেখেছেন। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান আসবে। নিয়মিত বাসে যাতায়াত করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক যাত্রী বলেন, ভাড়া নিয়ে ওদের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই। ওরা কারো কথা শোনে না। আসলে আমরা সাধারণ যাত্রীরা ওদের কাছে জিম্মি।
রাজধানীতে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় নিয়ে অভিযোগের কারণে তা নিরসনে ই-টিকিটিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৩০টি কোম্পানির বিভিন্ন রুটে এই ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এতে সরকারনির্ধারিত হারে একজন যাত্রী যত কিলোমিটার যাবেন, তিনি ঠিক তত দূরত্বের জন্য ভাড়া দেবেন। তবে সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাসে ঘুরে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র এখনো এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু কোম্পানির বাসে ই-টিকিট কাটলেও বেশির ভাগেই কাটছে না। মিরপুর রুটে চলা বিহঙ্গ ও সুপার, শেকড়, বিকল্প, আয়াতে এই চিত্র দেখা গেছে। মেশিনে রসিদ না দিয়েই হাতে টাকা নিচ্ছে। টাকা দিলেই তারা নিয়ে নিচ্ছে। চালকের সহকারী বা ভাড়া উত্তোলনকারীরা বলছেন, খুচরা ভাড়ায় সাধারণত টিকিট কাটা হচ্ছে না। আর যাত্রীর চাপ যখন বেশি থাকে, তখন কাটা সম্ভব হয় না।
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা জিসান বলেন। মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত বিহঙ্গ নামের একটি পরিবহনে যাতায়াত করেন ১৮ টাকায়। তিনি ই-টিকিটের মাধ্যমে টিকিট কাটেন। যেখানে আগে ভাড়া নিত ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেখানে ই-টিকিট চালু হওয়ায় ভাড়া কমেছে। তবে এই টিকিট তিনি বাসের হেলপারের কাছে চেয়ে নেন। যেসব যাত্রী টিকিট চান না, তাদের ই-টিকিট দিচ্ছেন না চালকের সহকারীরা। বেশির ভাগই এখনো আগের নিয়মে হাতে হাতে ভাড়া নিচ্ছেন। হেলপারের গলায় পজ মেশিন থাকলেও সেটি ব্যবহারে অনীহা রয়েছে তাদের। খুব কমসংখক বাসেই এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা রয়েছে। তবে কোনো বাসে এই টিকিট দেওয়া হয় না। টিকিট কাটার বিড়ম্বনা এড়াতে গড়পড়তা যাত্রীরা এ নিয়ে মাথা ঘামান না। ফলে এসব বাসে ই-টিকেটিংয়ের প্রচলন থাকলেও বাস্তবে তা নেই।
ঢাকার সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করার কথা ভিক্টর ক্লাসিক বাসের কিন্তু তারা যাচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পর থেকে! তবে এ জন্য ভাড়া কম নিচ্ছে না, বরং যাত্রীকে গুনতে হচ্ছে সাদরঘাট পর্যন্ত ভাড়া। ফিরতি পথেও সেই একই অবস্থা। যাত্রী নামবেন ভিক্টোরিয়া পার্ক, ভাড়া দেবেন সদরঘাটের। যাত্রীদের মনে প্রশ্ন জাগে কেনো বাড়তি ভাড়া? শুধু ভিক্টর ক্লাসিকেরই এ অবস্থা নয়, বিহঙ্গ পরিবহন, আকাশ পরিবহনসহ সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করা সব বাসের এক দশা। এর মধ্যে নতুন অনিয়ম যোগ হয়েছে ই-টিকিট না থাকা। রাজধানীতে ই-টিকিটের প্রথম যাত্রা মিরপুরকেন্দ্রিক হলেও আপাতত শেষ ধাপ সদরঘাট-গুলিস্তানকেন্দ্রিক হয়েছে।
গুলিস্তানে ভিবিন্ন বাসে ঘুরে দেখা গেলো একটি বাসেও যাত্রীর কাছ থেকে টিকিট দিয়ে ভাড়া আদায় করতে দেখা যায়নি। এমনকি অনেক যাত্রী জানেনও না যে ভাড়ার বিনিময়ে লোকাল বাসে তিনি টিকিট পাবেন। এ নিয়ে যাত্রীদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কন্ডাক্টরের দিক থেকেও যাত্রীর টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। যদিও বেশির ভাগ বাসের ভেতর জানালার গায়ে যাত্রীদের উদ্দেশে লেখা রয়েছে—টিকিট ছাড়া ভাড়া দেবেন না। এক যাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, কন্ডাক্টরের কাছে টিকিটি চাইলে তারা বলে প্রয়োজন নেই ভাড়া তো বেশি নিচ্ছি না।
অপরদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে বিআরটিএর পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করার কথা থাকলেও মিরপুর-গুলিস্তান রুটে ভাড়ার বিষয়ে কাউকে তদারকি করতে দেখা যায়নি। ফলে ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। আর প্রতিনিয়ত ভাড়া নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।
অন্যদিকে যাত্রীরা বলছেন, ই-টিকিট চালু হওয়ায় কিছু জায়গায় ভাড়া কমেছে, আবার কিছু জায়গায় বেড়েছে। তারা এটি সব বাসেই কার্যকর করার দাবি জানান। আবার কোনো কোনো বাসও শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নিতে চায় না। শুক্রবার স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই কোনো হাফ পাশ নেই। অন্য সময় অর্ধেক ভাড়া নেয় না। প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের ও পড়তে ভাড়া বিড়ম্বনায়। শিক্ষার্থী ও যাত্রীদের একটাই চাওয়া সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া যেন না নেয় সেদিকে একটু নজর রাখুক কর্তৃপক্ষ।