নিজের লাভের জন্য বিমানকে লোকসানে ফেললেন কর্মকর্তা!
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের রাজস্ব ও ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এফএমআইএস) বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. মিজানুর রশীদ। তার মূল দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বৃদ্ধি করা এবং ব্যয় কমানো। তিনি করেছেন ঠিক তার উল্টোটা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে অকার্যকর দুটি সফটওয়্যার কিনে বিমানের রাজস্ব কমিয়েছেন তিনি, বাড়িয়েছেন ব্যয়। এ কারণে বিমানকে গচ্ছা দিতে হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি।
ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠানকে লোকসানের মুখে ফেলার অভিযোগে জিএম মিজানুর রশীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মাইক্রোসফট এক্সেলের ফাংশন ব্যবহার করে নিজস্ব পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত প্রোগ্রাম ‘রুট কস্টিং’ (বিভিন্ন রুটের ফ্লাইট পরিচালনার মোট খরচ) এবং ‘রুট প্রফিটিবিলিটি’ (লাভসহ বিভিন্ন রুটের ভাড়া নির্ধারণ) প্রস্তুত করত। এ দুই কাজের জন্য জিএম মিজানুর রশীদ নিজের একক সিদ্ধান্তে এফপিএস এবং ফিনেস কস্ট অ্যান্ড বাজেট নামে নতুন দুটি সফটওয়্যার কেনেন। এক্ষেত্রে তিনি বিমানের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করেন। এছাড়া এ বিষয়ে বিমান পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনও নেননি তিনি।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিজানুর রশীদ যে দুটি সফটওয়্যার কিনেছেন তার জন্য ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে কেনা ফিনেস বাজেটিং সফটওয়্যারটি পরবর্তীতে চালু করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এটি কোনো কাজে আসেনি।
মিজানুর রশীদের বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি বিভাগীয় মামলা করে বিমান। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিজানুর রশীদ বিমানের সফটওয়্যার ক্রয়ের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিমানের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করেছেন। বিমানে কোনো সফটওয়্যার কেনার আগে তার বিকল্প সফটওয়্যার কী কী আছে, সেগুলোর বিষয়ে আরএফপি (রিক্যুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দিতে হয়। সেটি তিনি দেননি। এছাড়া তিনি বিমানের আইটি বিভাগ বা অন্য কোনো কমিটির পরামর্শ না নিয়ে ইন্টারফেস কস্ট সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করেন। প্রোটকল অনুযায়ী কোনোকিছু ক্রয়ের আগে যেসব কর্মকর্তার মতামত নিতে হয় তাদের সবার মতামতও নেননি তিনি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, অসত্য, মিথ্যা, মনগড়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বিমান ব্যবস্থাপনাকে ভুল পথে পরিচালিত করে এবং বিমান ক্রয় নীতিমালা যথাযথ অনুসরণ না করে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রশাসনিক আদেশ উপস্থাপনের মাধ্যমে সফটওয়্যার ২টি ক্রয় করায় বিমান বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যার দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
এতে আরও বলা হয়, মিজানুর রশীদ ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সুবিধা আদায়ের জন্য সফটওয়্যার কেনার দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে গোপন রেখে সরাসরি মেসার্স অ্যাকেলয়া কেল সলিউশন লিমিটেডের সঙ্গে ক্রয়চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন।
ক্রয়নীতি ভঙ্গ করায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তবে সেটি ‘সন্তোষজনক না’ হওয়ায় একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা নিবিড়ভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন। এরপর তার বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন দুই সফটওয়্যার কেনার আগে বিমান তার নিজস্ব পদ্ধতিতে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাজেটিং ও প্রফিটিবিলিটি নির্ধারণ করত। নতুন সফটওয়্যার কেনার কারণে বিমানের খরচ বেড়ে গেছে এবং রাজস্ব অনেকাংশে কমে গেছে।
দুই সফটওয়্যার কেনা যেভাবে বুমেরাং হয়েছে
মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিজানুর রশীদ যে দুটি সফটওয়্যার কিনেছেন তার জন্য ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে কেনা ফিনেস বাজেটিং সফটওয়্যারটি পরবর্তীতে চালু করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এটি কোনো কাজে আসেনি।
অপর সফটওয়্যার এফপিএস (ফ্লাইট প্রফিটিবিলিটি সিস্টেম) দিয়ে কাজ শুরু করা হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
বিমানের অর্থ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আগে বিমান নিজস্ব পদ্ধতিতে ৫-১০ বছরের আগাম পরিকল্পনা, উড়োজাহাজ ক্রয়ের ফিজিবিলিটি অ্যানালাইসিস করতে পারত। বর্তমানে এই সফটওয়্যারে এটি করা যায় না।
অর্থাৎ মিজানুর রশীদের কেনা দুটি সফটওয়্যারই আসলে কোনো কাজে আসেনি। উল্টো তার কেনা সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্ষতির মুখে পড়েছে বিমানের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা।
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সফটওয়্যার দুটি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মেসার্স অ্যাকেলয়া কেল সলিউশন লিমিটেডকে ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা প্রদান করে বিমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, ‘ক্রয়নীতি ভঙ্গ করায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি নোটিশের জবাব দিয়েছেন। তবে সেটি ‘সন্তোষজনক না’ হওয়ায় একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা নিবিড়ভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন। এরপর তার বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে গত তিন দিনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয় মিজানুর রশীদকে। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি তিনি।
মিজানুর রশীদের বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি বিভাগীয় মামলা করে বিমান। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিজানুর রশীদ বিমানের সফটওয়্যার ক্রয়ের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিমানের ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করেছেন। বিমানে কোনো সফটওয়্যার কেনার আগে তার বিকল্প সফটওয়্যার কী কী আছে, সেগুলোর বিষয়ে আরএফপি (রিক্যুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দিতে হয়। সেটি দেওয়া হয়নি।
তবে সফটওয়্যার কেনার বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশের উত্তরে তিনি যা বলেছেন তা গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।
নোটিশের উত্তরে মিজানুর রশীদ বলেছেন, ‘বিমানের জন্য একটি যুগোপযোগী সফটওয়্যার কেনার জন্য তৎকালীন সিএফও ভিনিদ সুদ বার বার লিখিত নির্দেশনা দেন এবং ই-মেইল করেন। সে মোতাবেক আমি সফটওয়্যার কেনার নথিটি বিমানের তৎকালীন কন্ট্রোলার অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস মঞ্জুর ইমাম এবং তৎকালীন এমডি-সিইওকে পাঠাই। তবে মঞ্জুর ইমাম এতে কোনো মতামত দেননি।’
এছাড়া ওই নোটিশের উত্তরে তিনি বলেছেন, যদি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অমান্য করতেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হতো। সেটা হয়নি।
অনিয়মের অভিযোগ ছিল আগেও
মিজানুর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। বিমান ক্রিকেট দলের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে তার বিরুদ্ধে ‘ইন্টার স্পোর্টস’ নামে একটি দোকান থেকে খেলাধুলার সামগ্রী কেনার নামে ভুয়া ভাউচার দিয়ে ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ বার ক্রীড়া সামগ্রী কিনেছেন তিনি। তবে ১ মাসের মধ্যে কেনা পণ্যগুলোর ভাউচার নম্বর ছিল যথাক্রমে ০০১, ০০২, ০০৩, ০০৪, ০০৫। এর অর্থ দাঁড়ায়, ওই এক মাসে বিমান ক্রিকেট টিম ছাড়া ওই দোকানে আর কোনো ক্রেতা ছিলেন না। যা খুবই সন্দেহজনক। অস্বাভাবিক ওই ভাউচারগুলোর কপি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।
দুর্নীতির নেশা পারিবারিক!
মিজানুর রশীদের পাশাপাশি তার দুই ভাইও বিমানে চাকরি করতেন। তাদের একজন মো. হারুন অর রশীদ এবং অপরজন মামুনুর রশীদ।
তার বড় ভাই হারুন অর রশীদ বিমানের বেতন শাখায় হিসাব তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালে দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুই মামলায় ৯ বছরের কারাদণ্ড এবং প্রায় ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত।
আরেক ভাই মামুনুর রশীদ বিমানের ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারে (বিএফসিসি) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে ৯০ দিনের বেতন দিয়ে তার সঙ্গে চাকরির চুক্তি বাতিল করে বিএফসিসি।