হৃদয়ে বিজয়ের মাস

হৃদয়ে বিজয়ের মাস

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে বিসর্জন দিয়েছে ত্রিশ লক্ষাধিক প্রাণ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন আমাদের মা-বোনেরা। তবুও লুটিয়ে যায়নি বাঙালি। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে শুরু হয়েছে বিজয়ের সন্ধানে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। এরপর দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামে পাকবেড়ি থেকে বাঙালি মুক্ত হয়েছে এই ডিসেম্বরে, এনেছে জয়ের সূয্য বিজয়। সকলের হৃদয়ে তাই অবিচল, স্মরণীয়, গৌরবগাথা বিজয়ের এই মাস।

আজ ডিসেম্বরের প্রথম দিন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি শহীদদের। মা-বোনের আত্মত্যাগ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের; তাঁদের ঋণ শোধ হবে না কোনদিন। এই ডিসেম্বরে বাঙালির যখন বিজয় আসন্ন তখন জাতির কাণ্ডারী বুদ্ধিজীবিদেরও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাঁরাও শহীদের তালিকায়। তাঁদের রক্তের বিনিয়ময়ে বিজয়গাথা এই ভূমির বয়স অর্ধশতাধিক পেড়িয়েছে। 

বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় আসে এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। অর্জন করে নিজস্ব ভূ-খন্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ মাসে।

বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণের এ মাসেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর আল-শামসদের সহযোগিতায় হানাদার গোষ্ঠী দেশের মেধাবী, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেয়ার ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় কোন নজির বিশ্বে নেই। সেই শহীদদের কৃতিত্বও স্বর্ণাক্ষরে লেখা।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল, স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি  বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যেখান থেকে ৭ মার্চ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ বলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আর জাতি অর্জন করে হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তাঁর ডাকে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র জনযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। 

কত চাঁদ-সূর্য্য, জোয়ার-ভাটা গত হয়েছে। নয় মাসে যারা অকৃত্রিম দেশপ্রেম ধারণ করেছেন, তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিজয় ছিনিয়ে এসেছেন; যত দিন গত হবে ইতিহাসের পাতায় আরও মহীয়ান হয়ে উঠবে তাঁরা। বাঙালি জাতিও শ্রদ্ধাভরে নত হবে।