দেশে রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় নান্দনিক রেডিমেড ঘরের চাহিদা বেড়েছে
দেশে রড ও সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুন্সীগঞ্জে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি নান্দনিক রেডিমেড ঘরের চাহিদা বেড়েছে। তাই এখন স্থানান্তরযোগ্য এমন ঘরের দেখা মেলে জেলার প্রতি বাড়িতেই। সুদিন ফিরেছে এসব তৈরিকৃত ঘর বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের। করোনার ধকল কাটিয়ে ব্যবসায় সুদিন ফেরায় খুশি এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা।
মুন্সীগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এই জেলার কমপক্ষে শতাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে এই ঘর তৈরির কারখানা। এসব স্থানে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয় ঘর। দূর-দূরান্ত থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা হতে পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের পছন্দের ঘরটি। বর্তমানে ঘরগুলোতে ভিন্নতা নিয়ে এসেছে টালী টিন। বিশেষ ধরনের কালারিং এই টিনের কারণে ঘরের নান্দনিক সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও গত কয়েকমাস ধরেই ঊর্ধ্বগতিতে রড সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকে সেই বাড়তি দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে। তাই এই সব রেডিমেড ঘরের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা।
অন্যদিকে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি এসব ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস অনায়াসে প্রবেশ করেতে পারে। আবহাওয়ার সঙ্গে ঘর দ্রুত ঠান্ডা ও গরম হয়। একটি পুরো ঘর অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। টাকার প্রয়োজনে বিক্রিও করেও দেওয়া যায়। ফলে এসব ঘরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বিগত প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময়ের আগে থেকে মুন্সীগঞ্জের বিভিন্নস্থানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঘর তৈরির কারখানা। দিন দিন এ সব কারখানগুলো ঘর তৈরিতে আনছে বৈচিত্র। কালার টিনের পাশাপাশি বর্তমানে যোগ হয়েছে ঢেউ খেলানো বিভিন্ন রঙের টালী টিন। কাঠ ও টিনের তৈরি এসব নান্দনিক ঘর বিক্রির জন্য জেলার কমপক্ষে শতাধিক স্থানে গড়ে উঠেছে ঘর বিক্রির হাট। মুন্সীগঞ্জের লোকজনের পাশাপাশি, ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চাদঁপুর, গাজীপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চিট্টগ্রাম জেলাসহ বাংলাদেশের প্রায় সব স্থান থেকে ক্রেতারা এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগে এ সব ঘর তৈরিতে বার্মার লোহাকাঠ, শালকাঠ ও টিনের ব্যবহার ছিল বেশি। কিন্তু বর্মার লোহাকাঠ বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় এ কাঠ এখন আর এদেশে তেমন পাওয়া যায় না। বৃদ্ধি পেয়েছে শাল কাঠের দামও। তাই ওই সমস্ত কাঠের বিকল্প হিসেবে বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া দেশিও কিছু কাঠ ব্যবহার হয়ে থাকে এ সব ঘর তৈরিতে। তবে লৌহজংয়ের ঘৌড়দোর এলাকায় দেশীয় কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরের কারখানাও রয়েছে। তবে দেশীয় কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরের মূল্য বিদেশি কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরের মূল্যের অর্ধেক।
লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৬০ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। একেকটি টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘর ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাটে ২-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামে ঘর বিক্রি হয়। তবে অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়েও ২-৩ তলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। নান্দনিক ডিজাইনের কারণে মুন্সীগঞ্জের সবকটি উপজেলায় এ ধরনের ঘরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জের প্রবাসীদের প্রথম পছন্দ বাহারি ডিজাইনের টিনের ঘর। জীবন যাপনে বৈচিত্র আনার জন্য পাকা ভবন নির্মাণের পাশাপাশি অনেকে আবার টিনের তৈরি ঘরও তৈরি করছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারসহ রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে এসব ঘর বিক্রির হাট। ঘর বানিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে জমির ওপর সাজিয়ে রাখেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা তাদের পছন্দের ঘরটির বাস্তব পরিপূর্ণ রূপ দেখে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান ।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগীনি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সবচেয়ে বেশি ঘর তৈরীর কারখানা রয়েছ। এর মধ্যে ঘর তৈরিতে সবচেয়ে প্রসৃদ্ধ হচ্ছে চুরাইন গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত ভিটায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের ঘর তুলে রাখা হয়েছে। শুধু চুরাইন এবং তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক ঘর তৈরির কারখানা।
এছাড়াও সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়ন ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়নেও রয়েছে একাধিক ঘর তৈরির কারখানা। টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বেতকা, বালিগাওঁ, কুন্ডের বাজার, দিঘিরপাড়, বাড়ৈইপাড়া, কালিবাড়ি, কামারখাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘর বিক্রির হাট রয়েছে। শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর ও দোহার সাড়কের বালাশুর বটতলা ও কামারগাঁও এলাকার রাস্তার পাশে খোলাস্থানে ঘর তুলে রেখেছেন ঘর ব্যবসায়ীরা। এছাড়া একই উপজেলার ভাগ্যকূল এলাকাও রয়েছে ঘর তৈরির কারখানা। সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর, ইছাপুড়া লৌহজং উপজেলার নওপাড়া, মালিলংক, হাট বুগদিয়া, বড় নওপাড়া এলাকায়ও ঘর বিক্রির হাট রয়েছে।
ঘর নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ দিয়ে বেশিরভাগ ঘর তৈরি করা হয়। এছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু ও ওকান কাঠের ঘরের চাহিদাও রয়েছে। একটি এক তলা ঘর নির্মাণ করতে ৫-৭ জন শ্রমিকের ৮-১০ দিন সময় লাগে। ঘরগুলো বিক্রি হয় ২ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকায়। এদিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা বিশিষ্ট ঘরগুলো তৈরি করতে ৫-৭ জন মিস্ত্রির ২০-২২ দিন সময় লেগে যায় এ সমস্ত ঘরগুলো সাধারণত ৭/১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। এর চেয়ে বেশি দামেও ঘর পাওয়া যায়। তবে সেগুলো অর্ডার করার পর বানিয়ে দেওয়া হয়।
এ সমস্ত ঘর তৈরীর প্রধান উপকরণ কাঠ বিক্রির বিভিন্নস্থানে গড়ে উঠেছে কাঠের ব্যবসা। বিশেষ করে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাওঁ বাজার দিঘিরপাড় বাজার, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুন্সীগরহাট, কাটাখালী, মীরকাদিম বাজারে, লৌহজং উপজেলার ঘোড়দৌর এলাকায় রয়েছে বড় বড় কাঠের দোকান। এ সমস্ত দোকানগুলোতে পাওয়া যায় সব ধরনের কাঠ।
এসব বাহারী ঘর নির্মাণে গোপালগঞ্জের শ্রমিকদের আলাদা চাহিদা রয়েছে মুন্সীগঞ্জে। এ জেলায় গোপালগঞ্জ জেলার এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক ঘর নির্মাণ কাজে জড়িত বলে কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগীনী এলাকার সততা ঘর বিতানের মালিক সাকির আহমেদ বলেন, করোনার কারণে এই ব্যবসা নিয়ে চরম হতাশা আর বিপাকে ছিলাম। কিন্তু রড সিমেন্টের দাম বাড়ার ফলে এখন এই ব্যবসা মোটামুটি ভালোই আছি। টিনও কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর যেমন অনায়াসেই এক স্থান হতে অন্য স্থানে হস্তান্তর করা যায়। অন্যদিকে এই ঘর যে কোন সময় বিক্রি করা যায়। টিন ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় একজন ব্যাক্তি ৫ বছর আগে যে ঘর কিনে নিয়ে তুলছেন বর্তমানে সে ঘর আরো বেশি মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন।
গোপালগঞ্জ জেলার মিস্ত্রি প্রশান্ত বালা বলেন, এই ঘরগুলো অনেক সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হয়। আমরা ঘরগুলো তৈরী করার পর আমাদের নিজেদেরই বিশ্বাস হয়না আমার এত সুন্দর করে ঘর তৈরি করতে পারি।
আরেক মিস্ত্রি উত্তম বলেন, আগে কালার টিনের বান ৫ হাজার টাকা ছিল। এখন নয় হাজার হয়েছে। নাইজেরিয়ান লোহা কাঠ কিভি এখন ২৬০০ টাকা। মাস ৬ আগেও কিভি ছিল ২২০০টাকা। এখানে তৈরি ঘরগুলোর কপাটের জন্য বিলিঙ্গা নামের কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিলিঙ্গা কাঠের দামও বেড়েছে তারপরেও সব মিলিয়ে ঘর বিক্রি এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
সেলিম নামের ঘর ব্যবসায়ী বলেন, বিদেশে থেকে ফিরে অনেক ব্যবসার চেষ্টা করেছি। সফল না হয়ে পড়ে ঘরের ব্যবসা শুরু করি। এখন এই ব্যবসায় মোটামুটি খেয়ে পরে ভালো আছি।
সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বলেন, রড সিমেন্টের দাম বাড়ায় এখন টিন কাঠের ঘরের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান হতে প্রতি মাসে এখন কমপক্ষে ১০টি ঘর বিক্রি হচ্ছে। শুধুমাত্র আমাদের সদর উপজেলার বজ্রযোগীনি এলাকায় ৪০ হতে ৪৫টি ঘর তৈরির কারখানা আছে । এই সমস্ত কারখানাগুলোতে নাইজেরিয়া হতে আসা লোহা, নিমবালু , বাচালু কাঠ দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়। এই কাঠগুলো অনেক শক্ত হয় ঘরগুলো অনেক স্থায়িত্ব হয়। আমরা এ কাঠগুলো পাশের বালিগাঁও, দিঘিরপার বাজার থেকে আস্ত গাছ কিনে এনে তারপরে নিজেদের মতো করে কেটে ঘর নির্মাণে ব্যবহার করে থাকি।