‘মামলা থেকে নাম আউট করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে’

‘মামলা থেকে নাম আউট করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে’

‘আপনার নাম মামলা থেকে একেবারেই আউট করে দেবো। এ জন্য ৫০ হাজার টাকা লাগবে। এখন কত দিতে পারবেন সেটা বলেন? যা দেবেন ১০ মিনিটের মধ্যে বিকাশে পাঠাতে হবে। সন্ধ্যার আগে থানায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।’ চট্টগ্রামের রাউজান থানার ওসি পরিচয়ে কদলপুর ইউনিয়নের সাবেক এক ইউপি সদস্যকে ফোন করে এভাবেই মামলা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করা হচ্ছে।

টাকা দাবির দুটি ফোন রেকর্ড একটি পাঁচ মিনিট ২০ সেকেন্ড অপরটি এক মিনিট ২৭ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ড এসেছে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদকের কাছে।

গত ২৮ আগস্ট কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রামের একটি মুরগির খামার থেকে শিবলী সাদিক হৃদয় (১৯) নামে এক কলেজ ছাত্রকে অপহরণ করা হয়। ঘটনার ১৩ দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর সকালে কদলপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রঙ্গিনছড়া পাহাড় থেকে শিবলীর খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনায় জড়িত উমংচিং মারমা (২৬) নামে গ্রেফতার এক অপহরণকারীর দেখানো মতে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে, শিবলী সাদিকের খণ্ডিত লাশ নিয়ে ফেরার পথে পুলিশের কাছ থেকে ঘটনায় জড়িত আসামি উমংচিং মারমাকে ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে উত্তেজিত গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। এর মধ্যে একটি পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ায় করেছে। অপরটি হচ্ছে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে হত্যার অভিযোগ। অজ্ঞাত গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে মামলা দুটি করা হয়।

মামলাটি করার পর গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন গ্রামবাসী। গ্রেফতার এড়াতে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রামটি। এমন পরিস্থিতিতে ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে একটি চক্র পুলিশ পরিচয়ে মোবাইলে কল করে টাকা আদায়ে মেতেছে।

এমন একটি কল আসে কদলপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিনের মোবাইল নম্বরে। তাকে কলের অপরপ্রান্ত থেকে রাউজান থানার ওসি পরিচয় দিয়ে, ‘এখন থেকে দশ মিনিটের মধ্যে টাকা পাঠিয়ে দিতে হবে। এখন কত দেবেন সেটা বলেন? ৫০ হাজার দিয়ে দেন। আপনার নাম একেবারেই মামলা থেকে আউট করে দিচ্ছি। টাকা না দিলে আপনি গোয়ামারা খাবেন। আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলছি মিয়া, এরপরও আপনি এমন করছেন। আপনি বেশি বোঝেন। আপনার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া যাবে এটা নিয়ে কারও সাথে বলাবলি করবেন না, বুঝেছেন। আপনি এখন কত দেবেন সেটা বলেন। সন্ধ্যার আগে আগে থানায় এসে ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। এখন ০১৮৭৬১৩৫৮৯ বিকাশ নম্বরে আপাতত ১০ হাজার টাকা পাঠান।’

ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশের ওসি পরিচয়ে ০১৭৯৪৭৩০৩৫০ নম্বর থেকে কল করে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। টাকা না দিয়ে গণপিটুনির মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে রাউজান থানার ওসি আবদুল্লাহ আল হারুন  বলেন, ‘গণপিটুনির ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত চলছে। কোনও গ্রামবাসীকে পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেফতার কিংবা হয়রানি করা হচ্ছে না। গ্রামবাসী যেন আতঙ্কিত না হয় সে জন্য আমার পক্ষ থেকে আশ্বস্ত  করা হলো।’

ওসি আরও বলেন, ‘আমার নাম ভাঙিয়ে কিছু কিছু লোককে কল করে টাকা দাবি করা হচ্ছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে করে জানিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

এদিকে, কদলপুর ইউনিয়নের পঞ্চপাড়া গ্রামের আবদুস সালাম, আলী আকবরসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী জানিয়েছেন, তাদেরকেও কল করে থানার ওসি পরিচয়ে টাকা দাবি করা হয়। তারা সরাসরি এসে টাকা নিয়ে যেতে বলেছেন। পরে টাকার জন্য কেউ আসেনি।

পুলিশ জানিয়েছে, শিবলী হত্যার সঙ্গে আট জন জড়িত। ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে মূলহোতা উমংচিং মারমাকে পিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) শিবলী সাদিক খুনের ঘটনায় আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেফতার অং ফ্রাই সিং মারমা (৪৬) নামে এক আসামি। ওই দিন সকালে নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন সানোয়ারা আবাসিক এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট জোনায়েদ আহমেদের আদালতে এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। অং ফ্রাই সিং মারমা রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালীর মাঝের পাড়া গ্রামের অং মারমার ছেলে।

পুলিশ জানিয়েছে, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে গ্রেফতার অং ফ্রাই সিং মারমা বলেছেন উমং চিং মারমার (গণপিটুনিতে নিহত) পরিকল্পনায় সেসহ ৭-৮ জন মিলে ২৮ আগস্ট মুরগির খামার থেকে শিবলীকে অপহরণ করে। শিবলী ওই খামারে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন। পরদিন তাকে পাহাড়ে নিয়ে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। এর আগে তাকে দিয়ে পরিবারের কাছে কল করান। মুক্তিপণ দিতে রাজি হলে অং ফ্রাই সিং মারমা বান্দরবানে চলে যান। পরে শিবলীর বাবা বান্দরবানে গিয়ে তার হাতে মুক্তিপণের দুই লাখ টাকা তুলে দেন।

ওসি বলেন, এর আগে গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে আরও দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলো- রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার বড়ইছড়ি এলাকার সুইচিংমং মারমা (২৪) ও একই এলাকার অংথইমং মারমা (২৫)। তারাও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।

তারা বলেন, খামারের তত্ত্বাবধায়ক শিবলীর সঙ্গে অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা ও ঝগড়া হয়। এরপর থেকে তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল খামারে কর্মরত আদিবাসী যুবকরা। তবে এই ঝগড়া মীমাংসা করে দিয়েছিল খামারের মালিক। এরপরও তারা শিবলীকে শায়েস্তা করার সুযোগ খুঁজছিল। গত ২৮ আগস্ট রাতে তাকে অপহরণ করে খামারে কর্মরত ওই যুবকরা।

-বাংলা ট্রিবিউন