নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীকে ‘সুবিধা’ দিতে পরীক্ষা কমিটিতে পরিবর্তন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষা কমিটি-২০২০ গঠনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক এ এ মামুন তার ক্ষমতার জোরে পরীক্ষা কমিটিতে একজনের পরিবর্তে অন্যজনকে অন্তর্ভুক্ত করতে বিভাগীয় সভাপতিকে বাধ্য করেছেন, এমন অভিযোগ করেছেন খোঁদ বিভাগের শিক্ষকরা।
বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মেয়েকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। ওই ছাত্রীর পরীক্ষার রোল নং ২০০৪৩৪।
জানা যায়, গত ২০২১ সালের ৪ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের (৪৫তম ব্যাচ) স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষা কমিটি-২০২০ গঠিত হয়। ওই কমিটির সদস্য অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করেন। পরে অধ্যাপক বদরুন্নাহারকে কমিটির সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়। অধ্যাপক বদরুন্নাহারের স্বাক্ষরেই নন থিসিস গ্রুপের ফল প্রকাশিত হয় এবং থিসিস গ্রুপের থিসিস জমাদানও সম্পন্ন হয়। কিন্তু ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর থিসিস গ্রুপের প্রেজেন্টেশন সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও হঠাৎ করে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তহমিনা ফেরদৌস অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করেই আগের দিন তা স্থগিত করেন।
এরপর ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক বদরুন্নাহার কমিটিতে রাখা না রাখা নিয়ে একাডেমিক কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ওই সভায় উপস্থিত অধিকাংশ শিক্ষকের অধ্যাপক বদরুন্নাহারকে রাখার পক্ষে মতামত দিলে অধ্যাপক এ এ মামুন তার ক্ষমতার জোরে ওই পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় সভাপতিকে অধ্যাপক বদরুন্নাহারের পরিবর্তে তার নিজের ল্যাবের সহযোগী গবেষক, অধ্যাপক শারমীন সুলতানার নাম পাঠাতে বাধ্য করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট (১৯৭৩) এর ৪৩ (৪) ধারা অনুযায়ী একাডেমিক কাউন্সিলে গঠিত পরীক্ষা কমিটির পরিবর্তন করতে হলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আবার একাডেমিক কাউন্সিলে উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অধ্যাপক বদরুন্নাহার পদত্যাগ না করায় অধ্যাপক শারমীন সুলতানাকে সদস্য ও টেবুলেটর হিসেবে পরীক্ষা কমিটিতে নিয়োগ দেবার প্রক্রিয়া এবং তাকে নিয়ে থিসিস প্রেজেন্টেশন সম্পন্ন করা ও থিসিস গ্রুপের ফল প্রকাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অধ্যাদেশের লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
বিভাগের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, অধ্যাপক এ এ মামুন জানতে পারেন তার ভাতিজি স্নাতকোত্তর কোর্স ভাইভা পরীক্ষায় ৫০ এর মধ্যে ৩৮ নম্বর পান। ভাতিজি কম নম্বর পেয়েছেন জেনেই অধ্যাপক এ এ মামুন বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় বিভাগের সভাপতি ও পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তাহমিনা ফেরদৌসের সঙ্গে অসদাচরণ করেন এবং পরীক্ষা কমিটিতে অধ্যাপক বদরুন্নাহারের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক বদরুন্নাহার বলেন, আমার স্বভাব হলো, আমি চেহারা দেখে নম্বর দেই না, খাতা দেখে নম্বর দেই। অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তহমিনা ফেরদৌস আমাকে সদস্য হিসেবে থাকার অনুরোধ করেন। কিন্তু বিভাগে এ নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। তখন তিনি আমাকে সদস্য হিসেবে রাখতে না চাইলে বিভাগে একটি মিটিং হয়। মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত আমাকে রাখার পক্ষে হলেও বিভাগের চেয়ারম্যান আমাকে পদত্যাগ করতে বলেন। আমি মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবো না বলে জানিয়ে দেই। পরে পরীক্ষার দিন সকাল ১০ টায় আমি উপস্থিত হলে বিভাগের চেয়ারম্যান আমাকে চলে যেতে বলে। তিনি আমাকে কোনো প্রকার নোটিশ না দিয়েই বিভাগের অন্য একজন শিক্ষিকাকে সদস্য হিসেবে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে সভাপতি অধ্যাপক তহমিনা ফেরদৌস বলেন, আমাদের বিভাগে শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ বিদ্যমান। বদরুন্নাহার আমাদের গ্রুপের নয়। অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ অপারগতা প্রকাশ করলে আমি ভুলবশত তাকে সদস্য হিসেবে নিয়ে নেই। নেওয়ার সময় অধ্যাপক বদরুন্নাহার যে আমাদের গ্রুপের নয়, তিনি সেটি জানায়নি। পরে থিসিসের ভাইবায় নম্বর থাকায় অনেকেই তার বিষয়ে আপত্তি জানায়। তখন এ যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আমি তার নাম পরিবর্তন করে আমাদের গ্রুপের একজন শিক্ষিকাকে সদস্য হিসেবে নেই।
এ বিষয়ে অধ্যাপক এ এ মামুন বলেন, অভিযোগটি মিথ্যা। বদরুন্নাহারকে অন্তর্ভুক্তি করাই অন্যায় ছিল। বিভাগে দুটি গ্রুপ রয়েছে। তিনি আমাদের গ্রুপে সদস্য ছিল না। প্রথমে কমিটির সভাপতি তাকে নিয়ে ভুল করেছিল, পরে তাকে বাদ দিয়ে শারমীন সুলতানাকে নিয়ে ভুল সংশোধিত করেছে। এ ছাড়াও অধ্যাপক শারমীন সুলতানার জুনিয়র অধ্যাপক বদরুন্নাহার। তাই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ‘ডাস্টি প্লাজমা ফিজিক্স’ পড়িয়েছি বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অনুরোধে। কিন্তু আমি পরীক্ষা প্রশ্ন প্রনয়ণসহ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত ছিলাম।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক এ এ মামুন ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী তার আপন ভাতিজি জানা সত্ত্বেও ‘ডাস্টি প্লাজমা ফিজিক্স’ শিরোনামে ৫০৭ নম্বর (ফুল ইউনিট) কোর্সটি তিনি পড়িয়েছেন, যা নীতি নৈতিকতা পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষকরা। তবে বিভাগীয় অনেক শিক্ষক কোর্সটি না পড়াতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি কোর্সটি পড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, ওই কোর্সের প্রশ্নকর্তা হিসেবে তারই ঘনিষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক সালাউদ্দিনকে নিয়োগ দেওয়ারও ব্যবস্থা করেন, যা বিভাগীয় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল নিরপেক্ষ মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এটিকে স্বজনপ্রীতির সুস্পষ্ট নমুনা হিসেবে মনে করছেন শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।